Sunday, July 8, 2018

সিদ্ধার্থ বসুর একগুচ্ছ কবিতা

মনকলম

কার মত মৌল সত্য? কে তার সবচে’ কাছাকাছি?
এ বাবদে তর্ক চলে : সত্যকে তত্বের ফাঁসে আঁটি
কোন তত্বে গাঁথবে নিত্য? কার ব্যাখ্যা জিতে নেবে মাটি?
বিতণ্ডা অনাদি-অন্ত, এ বলে, ও বলে : আমি আছি
কিন্তু এমনিভাবে যদি অবারিত ফুটত আলোচনা
সত্যি-মিথ্যে-সত্যি হয়ে আবহমানের সুর শোনা
যেত তবে; প্রতিপাদ্য-ভুল সিদ্ধান্তের পথে ফের
বয়ে চলত স্বচ্ছ পরিবর্তমান স্রোতাটি সত্যের
কিন্তু হায়, নৈর্ব্যক্তিক সংলাপের নির্মোহ সেকথা
ভাগাড়ে নিক্ষিপ্ত হয়ে জেগেছে বিধ্বংসী অন্ধতা
যুক্তি নয়, আনুগত্য; ধৈর্য্য নয়, আগ্রাসী আবেগ
স্বধর্মের নামে জমে সভ্যতার নীলাকাশে মেঘ
মেঘ থেকে হিংসা ঝরে, ঝরে পরঅস্বীকার ব্রত :
‘আমি মৌল, আদি আমি, অন্তিমেও সোহং সোহং’
ঈশ্বর-আল্লার নামে দাঁতে-নখে ঝলসায় অহং
‘আমাকে শ্রেয় না মানো, মুছে যাও, বেপাত্তা সতত’
যে ধর্ম মানুষ মারে—রাম কিম্বা খোদার নিদান
যে দেশ বোমারু দাগে ছিঁড়ে নিতে নির্বলের প্রাণ
সকলেই মৌল তারা, আদি-মধ্য-অন্ত নির্দ্বিধায়
গোটা দুনিয়াটা ওরা নিজের মুঠোর মধ্যে চায়
মুঠোই আসলে ধর্ম, মুঠো রাষ্ট্র, মুঠো মৌলবাদ
আকাশ-বাতাস ছেয়ে শুধুই আমির গন্ধ, স্বাদ
ধ্বংস হোক, ধ্বংস হোক অহং-এর এ উপনিবেশ
প্রতিটি মানুষ সত্যি, পুরো পৃথিবীটা একটা দেশ।


স্বাধীনতা

স্বাধীনতা বলতে তুমি কি বোঝো সুলতান?
স্বাধীনতা আপনার চোখে ঠিক কীরকম? বলুন শান্তনু
যে তল্লাটে আগাছারও চেয়ে সস্তা মানুষের প্রাণ, প্রানের সম্মান
যে দেশে থাপ্পড় খেয়ে গাল পেতে না দেওয়াটা অপরাধ
তত্বাবধান মানে বেপরোয়া ধর্ষণ যেখানে
একজনও গলা তুললে (কিম্বা না তুললে, অত কিছু তফাতও হয় না)
বেয়নেট কিম্বা বুলেটে
এফোঁড় ওফোঁড় হয়ে যাওয়াটাই শান্তিস্থাপন
কী বলবে তোমরা সেই এলাকার স্বাধীনতা নিয়ে?
উপদ্রুত? অরক্ষিত? আত্মরক্ষা পারেনা বলে কি ওরা স্বাধীনতা পায় না কখনো?
কীসের উপদ্রব, আহা, আমাদের মহল্লায় আমরা হয়ে বাঁচতে চায় বলে
খানিকটা পাক অধিকৃত
বাকি অংশ বাহিনী শাসিত
কারো ভরসা মার্কিন, কারো হাতে হাত রাখে চীন
সীমান্তে অবস্থান বড় গুরুত্বের, বড্ড গুরুতর
হয় আমাদের হও, নয়তো ওদের হয়ে আমাদেরকে মারো (ও পক্ষেও হয়ত ঠিক এমনি প্রচার হয়ে থাকে)
তারপর মরে যাও জনচিত্তরঞ্জন সুবাদে
এমনি করেই আমরা রক্ষা করি, এমনিই বরাভয় দানি,
জঙ্গিরা দুধকা দুধ, সৈনিকেরা পানিকা হি পানি
কাশ্মীর ভারতের না পাকিস্তানি ঘাঁটি
সে আমরা বুঝে নেব কার্গিল কি উরি ময়দানে
দেশে দেশে কি ভীষণ মৃত্যুর আবহ
সে ঢাকতে দুয়েকটা ছোট যুদ্ধ খুব দরকারী
এসো মরো, তোমাকে নিপুণভাবে মারি
এ বাবদে জানতে পারবে আরো বিস্তারিত, যদি, নিতান্তই বেঁচে যাও প্রাণে
এরকম লম্বা হয়ে চলতে থাকবে শান্তি আলোচনা
বলো তবে রাবেয়া খাতুন, তুমি স্বাধীনতা নিয়ে কী বলবে
বলুন তো শান্তা পাল আজাদী শব্দের ঠিক কীবিধ দ্যোতনা?


অভিজিৎ

আমি একা, বহুজন, আমি স্থিতি এবং প্রবাহ
আমার সামনে পিছে অহংএর অন্ধকালো গুহা
গুহার গহন থেকে ভেদ-দ্বেষ-হিংসার প্রদাহ
ছাই করে দিতে চাইছে প্রানধর্ম; শুধুই অসূয়া
অন্তিম ধর্মের তত্ব, ধর্মের চূড়ান্ত সত্যরূপ
হয়ে ছারেখারে দিচ্ছে মানুষের সাজানো বাগান
উত্তপ্ত রক্তের ছাঁটকে মনে হচ্ছে বিদগ্ধ বিদ্রূপ
উল্লাসে ও আর্তনাদে কথা ও নৈঃশব্দ খানখান
পিষে যেতে পারি আমি বেশরম সভ্যতার দাঁতে
এমন আঁধার দিনে আলো হয়ে পোড়াটাই রীত
সাবেক অন্ধতার জটাজাল জড়ানো দুহাতে
মরেও মরিনা, ফের জন্ম নিই লক্ষ অভিজিৎ....


স্তব্ধতার গান

দুচার লাইন লিখবো, কিন্তু শুরুর আগে
একটা মিনিট নীরব থাকার আর্জি জানাই
তাদের জন্য, মরলো যারা শিলদা থানায়,
অপ্রস্তুতে যাদের বুকে বুলেট লাগে
বুলেট লাগে যাদের বুকে শিলদা ঘাঁটি,
ছিন্নভিন্ন যাদের দেহ দান্তেওয়ারায়,
অন্যায্যতার প্রদর্শনী ন্যায্য পাড়ায়-
বিষাদ এবং বিরোধ জানাই নীরব,খাঁটি
কিন্তু কেন চুপ থাকা এই একটি মিনিট?
মৃত্যু কি এই, শুধুই কি এই কয়েক ডজন?
কিম্বা কিছু বেশিই হবে, মরল কজন--
গুনছে কি কেউ? রাখছে হিসেব? তেমন সিনিক
কেই বা আছে? কার হাতে বা অধিক সময়?
এক মিনিটেই যা হয় করো, তার বেশি নয়
দু-চার লাইন লিখবো কিন্তু তার মহড়ায়
বলিই যদি শ্মশানগন্ধী কালাহান্ডি?
লিখিই যদি গুজরাট-এই নাম?
অযোধ্যা আর ভূপাল...আরো বলেই চলি?
বিষ গিলে দিন কাটছে কাদের যদুগোড়ায়?
অনামা কোনো কেওনঝড় গ্রাম?
আমলাশোলের সংখ্যাতীত কৃষক
মরল রোগে অথবা অনাহারে?
আধা-সৈনিক নলের মুখে নিছক
ঝরলো কারা ঝাড়গ্রামে, বস্তারে?
তুলোর চাষে জোয়ার এলো বিদর্ভতে
সবুজ দিনের উঠলো সূর্য,পারের কড়ি
গুনতি করে কৃষক দিলো গলায় দড়ি-
খনির তালাশ এ জঙ্গলে, ও পর্বতে
মরল মানুষ নন্দীগ্রামে, সিঙুরে, হাতিলোধে
বুলেটে কেউ, লাঠির ঘায়ে, খোলা বঁটির কোপে
থেঁতলে গেল জমিতে কত, পথের ধুলোয়, ঝোপে
নদীর স্রোতে ভাসলো শরীর, অমান্যতার শোধে
তাদের জন্য দু-এক দন্ড ধার্য করুন নিথর সময়,
তাবত্ তর্ক বেবাক পন্ড, কব্জিঘড়ি গুনুক প্রমাদ
ভুল হয়ে যাক, বাড়ুক আরো দু-তিন-চারটে পল
যাক যেদিকে গড়াতে চায় যেতল্লাটের জল
কাশ্মীরের ওই উপত্যকায় মরছে যারা,
পুড়ছে যারা মনিপুরের উপকন্ঠে,
ভিটে-মাটি লোপাট যাদের এবং যারা
ধর্ষিতা হয় বাংলা, বিহার ও ঝাড়খন্ডে,
তাদের ভেবেও নীরবতা করুন পালন,
ঘড়ি দেখুন দু-পাঁচ মিনিট তাদের জন্য
মরিচঝাঁপির জন্তুদেরও করুন ধন্য,
দেখুন ঘেঁটে তাদেরও আজ মন্দ-ভালো
কিন্তু শুধুই নীরব কেন থাকবো আমরা?
মানুষ শুধুই বুলেট কিম্বা বোমায় মরে?
শুধুই কাঁপে ছাড়িয়ে নিলে গায়ের চামড়া?
দেখবো বেছে এমন কেচ্ছা এ চত্বরে?
সন্ত্রাস ঠিক আছেই ভরা সিস-বুলেটে
আল্লাতালার দখল যেমন দুনিয়াদারী,
বেচাল হলেই সবুট লাথি পড়বে পেটে-
পলকা-তোমায় পিষবে সে, যার ওজন ভারী
কিন্তু বুলেট ছাড়াও কি নেই আজন্ম ত্রাস?
আমৃত্যু তার ন্যাংটো ছবি নেই ঝোলানো?
কয়জনে খায় পাহাড়প্রমাণ, একমুঠো গ্রাস
জোটেনা যার তার সমুখে নেই দোলানো
পেটমোটাদের তেলমাখা গা, হড়হড়ে গাল?
স্বচ্ছ কাচের দরজা-দেয়া সন্ধ্যে-সকাল?
বাইরে যারা ডিগবাজি খায় শুকনো মুখে,
হাওয়ার সঙ্গে ভয় ঢুকে যায় তাদের বুকে|
কাল কী খাবো? যাবো কোথায়? বাচ্চাগুলো?
স্বভাব বলুন, কিম্বা রুচি, শুকনো ধুলো
চিবিয়ে যার দিন কেটে যায়, রাত্রি আসে,
কোন জরিপে আসবে প্রমাণ তেমন ত্রাসের?
মরছে মানুষ, অভাব শুধু, সর্বগ্রাসী,
প্রাচুর্যেরও প্রদর্শনী নগ্ন, ছেনাল
শুধুই নীরব থাকতে যদি আমরা আসি,
থেঁতলে যাবো ওদের সাথেই আজ বাদে কাল
নীরব থাকুন দু-একমিনিট শুরুর আগে,
ঠিক তখনি দু-এক লাইন লিখবো আমি,
লক্ষ-কোটির মৌনতা এই, ভীষণ দামী
ফাঁসিয়ে দিয়ে মানুষ যেন এবার জাগে।

আগুন

আমার প্রেম জায়গা খোঁজে ভিতরবাগে
অন্ধকারে আমার দেশে আগুন জাগে
আগুন জাগে কাশ্মিরে ওই আমার দেশে
প্রেমের আগুন হার না মানা জ্বলছে হু হু
কত প্রণয় উজাড়? কজন নিরুদ্দেশে?
বিরহরসে উথলে ওঠে আমার রুহু
ছুটছে গুলি বছর ভরে, তাজা বুলেট
লক্ষ্য মাথা, হৃদয় এবং নিশানা পেট
নিভছে আলো দিন-রাতে ওই দুটো চোখের
আসবে স্বরাজ, সময় কোথায় কোমল শোকের?
যদিও প্রেমে মগ্ন আমি, বিষাদকাতর
শুনছি যেন ঘন্টা বাজে দূর পাহাড়ে
জাগছে মাটি, বরফ জাগে, জাগছে পাথর
কত যুগের বলাৎকার এই? লক্ষ্য হাড়ের
তলায় চাপা ধ্বংস আগুন উঠছে ফুঁসে
সব মানুষের আজাদী চায় সব মানুষে

No comments:

Post a Comment