Sunday, July 22, 2018

কার্ল মার্ক্সের জন্ম-দ্বিশতবর্ষ উপলক্ষে সেসটাস আয়োজিত আলোচনা শিবির - একটি প্রতিবেদন

তন্ময় রায়

মার্ক্সের জন্ম-দ্বিশতবর্ষ উদযাপন উপলক্ষে দুদিনের আলোচনা শিবির আমাদের উদ্যোক্তাদের কারণেই শুরু করতে খানিকটা দেরি হয়ে গিয়েছিল। ১১-৩০এর বদলে ১২ টায় যখন শুরু হল এবং ডাঃ সুমিতা দাস যখন বলতে শুরু করলেন, তখন সত্যই বোঝা গেল, সময় নষ্ট করলে কতটা ক্ষতি হয়। মার্ক্সবাদ চর্চা কেন প্রয়োজন বলতে গিয়ে তিনি দেখালেন, এই চিন্তাধারা কীভাবে তাঁকে ইতিহাসের তথ্য অরণ্যে পথ খুঁজে নিতে সাহায্য করেছে এবং প্রচলিত ইতিহাস চর্চার বাইরে গিয়ে ইউরোপীয় বিজয়ী জাতিগুলির গৌরব গাথা পড়তে পড়তে আমরা ভুলে গিয়েছিলাম, বিজিত দেশ ও জাতিগুলির মর্মান্তিক মৃত্যু যন্ত্রণার কথা। মার্ক্স স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন, ধনতন্ত্রের অগ্রগতির পেছনে আছে পুঁজির আদি সঞ্চয় ও উপনিবেশগুলির আদিবাসীদের রক্ত ঘামের কথা, তাদের উচ্চমানের সভ্যতা ধ্বংসের নীরব কাহিনী। একই ভাবে মার্ক্সবাদের আলোকেই বোঝা যায় বিজ্ঞানের নানা সমস্যাকে, দূর করা যায় বিভিন্ন বিভ্রান্তিকে। তাই তিনি সেস্টাসের উদ্যোগে আয়োজিত দুদিনের এই আলোচনা শিবিরকে এবং এতে অংশগ্রহণকারীদের অভিনন্দন জানান।

অনুষ্ঠানটির আয়োজন করা হয়েছিল যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে। একেবারে প্রারম্ভে সদস্য অনর্ঘ মুখোপাধ্যায় মার্ক্সের উপর রচিত একটি জার্মান ভাষায় লেখা গান, তার ইংরেজি অনুবাদ এবং অবশেষে তাঁর স্বরচিত একখানি গান শুনিয়ে সভার মধ্যে যেন গাম্ভীর্যের সিম্ফনি বেঁধে দিলেন!

সম্পাদকমণ্ডলির সদস্য ডঃ কুন্তল ঘোষের সঞ্চালনায় শুরু হল প্রথম অধিবেশনের আলোচনা, মার্ক্সের জীবন ও সংগ্রাম নিয়ে। বক্তা ছিলেন ডঃ অজিত কুমার রায়, সেস্টাসের অন্যতম সহ-সভাপতি। তিনি একেবারে বাল্যকাল থেকে শুরু করে মার্ক্সের মার্ক্স হয়ে ওঠার এক অনবদ্য অশেষ কাহিনি শোনালেন ৯১ মিনিট ধরে। যখন তিনি বলছেন, একটা সময় পয়সার অভাবে মার্ক্সকে ঘরের অন্যান্য আসবাবের সঙ্গে তাঁর পরার স্যুটকোট পর্যন্ত বন্ধক দিতে হয়েছিল এবং তিনি লাইব্রেরিতে যেতে পারছিলেন না—শ্রোতাদের চোখ তখন ভারি হয়ে এসেছিল। একের পর এক সন্তানদের অকাল মৃত্যু, স্ত্রী জেনির মৃত্যু, তাঁর নিজের প্লুরিসি সংক্রমণ, আর তার মধ্যেই চলেছে পুঁজি গ্রন্থের প্রকাশ ও সংস্করণ, অন্যান্য খণ্ডের প্রস্তুতি, আরও অনেক লেখা, আন্তর্জাতিকের কাজকর্ম পরিচালনা। আবেগে ডঃ রায়ের চোখের পাতাও বুঝি টলটল করে উঠেছিল!

মধ্যাহ্ন ভোজনের পরই শুরু হয়ে গেল দ্বিতীয় অধিবেশন। সঞ্চালক সিদ্ধার্থ বসু, সেস্টাসের অন্যতম সহ-সম্পাদক। বিষয় ছিল মার্ক্সবাদের আলোকে সাহিত্যের সমস্যা। বক্তা—ভাস্কর গুপ্ত, সেস্টাসের অন্যতম সহ-সভাপতি। সংস্কৃত, বাংলা ও ইংরেজি সাহিত্যের ইতিহাস নানা পর্ব মন্থন করে তিনি দেখালেন, সাহিত্যের সঙ্গে সমাজ কীভাবে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত থাকে, সমাজের বাস্তবতা কেমন করে সাহিত্যের পাতায় প্রতিফলিত হতে থাকে, শ্রেণিবিভক্ত সমাজে সাহিত্য কেন শ্রেণি দৃষ্টিভঙ্গির বাইরে যেতে পারে না। প্রচুর তর্ক বিতর্ক হল তাঁর এই শেষ উপপাদ্যটি নিয়ে। আধুনিক কবিতার ভাষা ও উপস্থাপন বোঝার ক্ষেত্রে কীভাবে শ্রেণি বিচার কঠিন হয়ে ওঠে তাই নিয়েই চলল এই খোলামেলা বিতর্ক।

দ্বিতীয় দিনের প্রথমে ছিল ডঃ শুভাশিস মুখোপাধ্যায়ের মার্ক্সবাদ ও পরিবেশসমস্যা বিষয়ক আলোচনা। সঞ্চালক তরুণ চক্রবর্তী, সেস্টাসের সদস্য, কিছু প্রশ্ন উত্থাপন করলেন, সাম্প্রতিক কিছু কিছু প্রবন্ধের উল্লেখ করলেন, যা পড়া দরকার এবং চর্চা করা দরকার। ডঃ মুখোপাধ্যায় দেখালেন, মার্ক্স এঙ্গেল্‌স থেকে শুরু করে লেনিনের রচনাতেও পরিবেশ নিয়ে চিন্তার প্রকাশ আছে, যদিও আজ আমরা যেভাবে সমস্যাটিকে দেখি, সেই ভাবে দেখা তাঁদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। তিনি সোভিয়েত সমাজের ইতিহাসের বিভিন্ন পর্বে পরিবেশ রক্ষার উৎকণ্ঠা থেকে কীভাবে বিশাল আকারের অরণ্য সৃষ্টি করা হয়েছে, তার বিস্তৃত তথ্য দিয়ে প্রমাণ করেন, এই বিষয়ে আমরা কতখানি অজ্ঞ! আজ যে আবহবিদ্যা নিয়ে এত কথা হয়, তারও সূচনা হয় সোভিয়েত সমাজের বিজ্ঞানীদের হাতেই। তিনি বিজ্ঞানের মতো করেই মার্ক্সবাদকেও সৃজনশীল দৃষ্টিতে পাঠ করা ও অনুধাবনের উপর গুরুত্ব আরোপ করেন।

চতুর্থ পর্বের বিষয় ছিল বিজ্ঞান দর্শন ও মার্ক্সবাদ। সঞ্চালন করলেন ডঃ মাখনলাল নন্দগোস্বামী, সেস্টাসের অন্যতম সহ-সভাপতি। আলোচনা করলেন সেস্টাসের সম্পাদক অশোক মুখোপাধ্যায়। তিনি বিজ্ঞানের বিভিন্ন আবিষ্কার কীভাবে উনিশ শতকে এক সময় মার্ক্সীয় দ্বন্দ্বতত্ত্বের আবির্ভাব সুনিশ্চিত করেছিল সেই ইতিহাস শ্রোতাদের শোনালেন। আবার আজকের দিনে বিজ্ঞান নিয়ে, সমাজ নিয়ে, অর্থনীতি নিয়ে যত রকম বিভ্রান্তি রয়েছে, তারও উত্তর যে কেবল মাত্র মার্ক্সবাদের কাছেই পাওয়া যাবে, তারও অনেক উদাহরণ তুলে ধরলেন। অনর্ঘর গাওয়া আন্তর্জাতিক সঙ্গীতের সুর মুর্ছনায় সভার পরিসমাপ্তি ঘোষিত হল।

No comments:

Post a Comment